ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীনতার কথাই বলেননি একই সাথে কোটি কোটি মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। অর্থনৈতিক মুক্তি এবং খাদ্য ও পুষ্টির অভাব থেকে মুক্তির জন্য চিন্তা করেছেন। তাঁর চিন্তা চেতনার হাত ধরেই তাঁরই কন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সকল মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ সেক্টর। শুধু দুই বেলা দুমুঠো ভাত খেলেই হবে না। মেধাবী জাতি গঠনে পুষ্টিকর খাবার এবং আমিষ ও স্নেহ জাতীয় খাবারের জোগান এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম কৃষিবিদদের ক্লাস ওয়ান মর্যাদা দিয়েছিলেন। বর্তমানে তারই চিন্তার ফসল হিসাবে আজ আমরা আমিষের ঘাটতি থেকে বাড়তি অবস্থানে এসেছি। আমরা বঙ্গবন্ধু কন্যার নির্দেশনায় ভেটেরিনারিয়ান এবং কৃষিবিদদের ঐকান্তিক চেষ্টায় আমদানি থেকে রপ্তানির পর্যায়ে আসতে পেরেছি। যখন দেশের জনসংখ্যা মাত্র ৭-৮ কোটি ছিল তখনই দেশে আমিষের প্রচÐ ঘাটতি ছিল। এখন প্রতিটি মানুষ প্রতিদিনই মাংস দুধ ডিম খেয়ে থাকেন। পুষ্টিহীনতার কারণে রোগগুলোর হাত থেকে এখন দেশের মানুষ নিরাপদ।
গরু ছাগল পালনের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা চলমান আছে। গ্রামের মেয়েরাই কয়েকটি করে গরু ছাগল অনায়াসেই পালন করে তাদের সংসার চালিয়ে আসছেন। বর্তমানে মুসলমানদের ইদুল আজহার গবাদিপশু এখন আমাদের দেশের পশু দিয়েই চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মিল্ক ভিটা প্রতিষ্ঠা করে ডেইরি সেক্টরকের অগ্রযাত্রাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। তিনি ডেইরি জোনকে লাভজনক করার জন্য সকল পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিলেন। সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় ভালো ভালো ব্রিড আমদানি করে এসব অঞ্চলকে দুগ্ধ অঞ্চল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর তৈরি করা এবং স্বপ্নের মিল্ক ভিটার মাধ্যমে খামারিরা দুধের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন। ঠিক তেমনি ভোক্তারা পাচ্ছেন ভালো মানের দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যসম্ভার। বর্তমানে বাংলাদেশের ডেইরি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে খামারিদের থেকে সবচেয়ে বেশি দামে এবং বেশি পরিমাণে দুধ সংগ্রহ করে থাকেন।
বর্তমানে আগের চেয়ে গুঁড়োদুধ কম আমদানি করা হয়। বাংলাদেশ এখন মাংস উৎপাদনে স্বনির্ভর। মানুষের জনপ্রতি গ্রহণের হার বেড়েছে অনেকাংশে।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশ যেন সব কিছুতেই বিদেশের ওপর নির্ভর না করে। তিনি স্বাধীনতার কথা বলার সাথে সাথে মুক্তির সংগ্রাম কথাটি বলেছেন। আমরা ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েই তার স্বপ্নকে স্তব্ধ করে দেননি। তিনি মুক্তির জন্য প্রতিনিয়ত শ্রম ও মেধা এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ১৯৭১ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণ পর্যন্ত সর্বদা মানুষের মুক্তির ও পুষ্টির নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য সকল বিষয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
প্রাণিসম্পদের উন্নতির জন্য দেশে প্রতিষ্টিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। এখান থেকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বাস্তবিক বিষয়ে গবেষণা হয়ে প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। পূর্বে গবাদি প্রাণির অসংখ্য রোগবালাই অনেক প্রাণী মারা যেত, কিন্তু বর্তমানে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ এবং বিজ্ঞানসম্মত খামার ও পরিচর্যায় রোগের প্রকোপ ও মৃত্যু অনেকাংশে কমানো সম্ভব হয়েছে।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তির উপায় প্রাণিসম্পদ : গ্রামের মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা এবং পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিতে অন্যতম হাতিয়ার প্রাণিসম্পদ। ছোট থেকে বড় যে কোন পরিসরে খামার করে লাভবান হচ্ছেন সবাই। গ্রামে একটি ডেইরি খামার একদিকে যেমন উদ্যোক্তার আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উপায় ঠিক তেমনি এলাকার মানুষের তরল দুধের চাহিদা পূরণ করে পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মহিলাদের আর্থিক লাভবানের একমাত্র উপায় এই প্রাণিসম্পদ। গ্রামের মহিলারা তাদের হাতে সর্বদা টাকা থাকে যারা মুরগী, হাঁস, ছাগল ও গরু লালন পালন করেন। যাদের ডিম ও দুধ কিনে খাওয়ার সামর্র্থ্য নাই তারাও নিজেরা মুরগী ও গরু লালন পালন করে পুষ্টি ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু এই সোনার বাংলা গড়তে পুষ্টি খাদ্যে সমৃদ্ধ মেধাবী জাতি গঠনের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে আমিষ ও স্নেহজাতীয় খাবার গ্রহণের প্রবণতা বেশি হওয়ার মেধাবি ও সুস্থ স্বাভাবিক সন্তান জন্মদানের সংখ্যা আগের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা মেধাবী জাতি গঠনের জন্য একটি সুসংবাদ। গ্রামের মানুষের পুষ্টির জন্য কারো প্রতি নির্ভর করতে হয় না। মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য গ্রামের পরিবেশ এখন অনেকাংশে শহরে সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।
করোনাকালীন সময়ে পুষ্টি নিরাপত্তা দেবে প্রাণিসম্পদ : মহামারী করোনাভাইরাসের আক্রমণে সারা বিশ্ব কুপোকাত। প্রতিনিয়ত বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা এবং বাড়ছে লাশের মিছিল। করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে বাদ পড়েনি বাংলাদেশও। এ দেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে। প্রাণিজ প্রোটিন এর গঠন বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষের ইমিউনিটি বৃদ্ধিতে সবচেয়ে ভ‚মিকা রাখে প্রাণিজ আমিষ। মাংস, ডিম ও দুধের মধ্যে উপকারী এমাইনো এসিড এবং অন্যান্য মূল্যবান উপাদান আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উন্নত করে।
বর্তমানে চিকিৎসকরা যাদের করোনা পজিটিভ পেয়েছেন এবং যে কোন সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চিকিৎসার পাশাপাশি প্রাণিজ আমিষ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন।
উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার উপরে থাকায় সকল প্রাণিজ আমিষ বিশেষ করে ডিম, দুধ ও ব্রয়লার মাংস নায্যমূল্যে এবং মানুষের নাগালে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিন একটি করে ডিম এবং এক গøাস দুধ যে কোন বয়সের মানুষের শারীরিক সমস্যায় ভাল ফল প্রদান করতে পারে।
করোনাকালে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির উপায় প্রাণিসম্পদ : এই মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দেশের শিল্পের এক বিরাট ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। বিদেশী ক্রেতা কম, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় খাদ্য ছাড়া অন্যান্য সকল শিল্পে একটি ধস নেমেছে। এমন অবস্থায় মানুষের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখার জন্য প্রাণিসম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ছোট, মাঝারি এবং বড় যে কোন পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ খামারি এবং উদ্যোক্তারা এখন ব্যবসায় লাভ করতে পারবেন। এই মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের জন্য মাননীয় প্রাধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রণোদনা দিয়েছেন। বর্তমানে খামারিরা ডিম, দুধ ও মাংশের উৎপাদনমুখী শিল্প চালু করলে ভাল মুনাফা অর্জন করতে পারবেন। করোনাভাইরাসের কারণে পূর্বের তুলনায় প্রাণিজ আমিষ ও স্নেহ জাতীয় খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে প্রাণিসম্পদের পুষ্টি উপাদানের চাহিদা বেড়েছে। এক্ষেত্রে নতুন করে উদ্যোক্তা হওয়ার একটি ভাল সুযোগ রয়েছে।
বর্তমান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী প্রাণিসম্পদের উন্নতির জন্য নিবেদিত হয়ে সর্বদা সকল দিকনির্দেশনা প্রদান করছেন। তার এই নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মচারীগণ প্রাণিসম্পদের উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক শক্তিতে আরো বেগবান করতে এখন সবচেয়ে ভ‚মিকা রাখতে পারে প্রাণিসম্পদ। ইউরোপের দেশগুলো তাদের প্রাণিসম্পদকে অগ্রাধিকার দিয়ে সর্বোচ্চ স্থান অর্জন করতে পেরেছেন। বাংলাদেশ সরকার ডেইরি ও প্রাণিসম্পদকে আরো শক্তিশালী করতে বেশ কিছু বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছেন, যেমন এনএটিপি, এলডিডিপি প্রভৃতি। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের দুধ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে প্রকল্পের পরিচালনা পরিষদ থেকে শুধু করে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এলডিডিপি প্রকল্পের মাধ্যমে খামারিরা সরাসরি লাভবান হতে পারবেন। ডেইরি হাব এবং ডেইরি শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। গুরুর সংখ্যা না বাড়িয়ে দুধ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে দেশের দুধের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলাদেশ গড়তে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ সেক্টর তার কাক্সিক্ষত সাফল্যে পৌঁছাতে পারবে। মাঠপর্যায়ের কর্মচারী বৃদ্ধি করে জনগণকে উপযুক্ত সেবা প্রদাণের মাধ্যমে দেশ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত বিশ্বে পরিণত হবে। য়
ডিভিএম, প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (এলডিডিপি), উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল, পভালাহাট, চাপাইনবাবগঞ্জ মোবাইল : ০১৭০২৩৭৮৬৮৭৭, ই-মেইল : mmrdvm10@gmail.com